শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত সদাসন্ত্রস্ত করে রাখে।
যারা নলি বানিয়ে ভেসে পড়ে- তাদের দৃষ্টি দিগন্তে আটকায় না।
শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলে এসে নিদ্রাচ্ছন্ন ট্রেনটির সমস্ত চেতনা জেগে সজারুকাঁটা হয়ে ওঠে। • শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।
স্বাভাবিক সরুগুলা কেরাতের সময় মধু ছড়ালেও এদিকে দীনতায় আর অসহায়তায় ক্ষীণতর হয়ে ওঠে।
দুরান্ত কোনো এক অতীতকালের অরণ্যে আর্তনাদ করে-কেতাবগুলোর বিচিত্র অক্ষরগুলো।
খোদার এলেমে বুক ভরে না তলায় পেট শূন্য বলে।
মসজিদের বাঁধানো পুকুরপাড়ে চৌকোণ পাথরের খণ্ডটার ওপর বসে শীতল পানিতে অজু বানায়।
কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগ করে তারা হয়- জাহাজের খালাসি, কারখানার শ্রমিক, বাসাবাড়ির চাকর, দফতরির এটকিনি, ছাপাকানার ম্যাশিনম্যান, টেনারিতে চামড়ার লোক, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন।
গারো পাহাড়ে যাওয়া সরকারি কর্মচারী-নতুন খোলস পরা নব্য শিক্ষিত মুসলমান, বাইরে বিদেশি পোশাক, পায়ে বুট আঁটা, মুখমণ্ডল মসৃণ।
গারো পাহাড়ে দূর জঙ্গলে বাঘ ডাকে।
ক্বচিৎ হাতিও দাবড়ে কুঁদে নেমে আসে।
দিনে ৫-৭ বার দীর্ঘ শালগাছ ছাড়িয়ে মৌলভির ক্ষীণগলা জাগে।
একদিন শ্রাবণের শেষাশেষি নিরাক পড়েছে।
শ্রাবণের শেষদিকে লোকেরা ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে বের হয়। সঙ্গে কোঁচ-জুতি নিয়ে দু-দুজন করে ডিঙ্গিতে করে বের হয় মাছ ধরার জন্য।
তাহের দাঁড়িয়ে সামনে, চোখে তার তেমনি শিকারির সূচাগ্নে একাগ্রতা । লোকেরা স্থির-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনুকের মতো টান হয়ে ওঠা তাহেরের কালো দেহটির পানে।
মতিগঞ্জ সড়কের ওপরেই একটি অপরিচিত লোক আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, শীর্ণ মুখে ক-গাছি দাঁড়ি, চোখ নিমীলিত।
মতিগঞ্জের সড়ক থেকে উত্তর দিকে খানিকটা এগিয়ে মহব্বতনগর গ্রাম।
মজিদ মহব্বতনগরে ঢুকে খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে যায়।
গ্রামের বৃহৎ বাঁশঝাড়ের ক-গজ ওধারে পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে টালখাওয়া ভাঙা প্রাচীন কবরকে মজিদ মোদাচ্ছের পিরের মাজার বলে জানায়।
অশীতিপর বৃদ্ধ সলেমনের বাপ হাঁপানির রোগী- সে দম খিঁচে লজ্জায় নত করে রাখে চোখ।
গারো পাহাড়- মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ পেরিয়ে।
ঝালরওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত হলো মাছের পিঠের মতো কবরটি।
গোঁয়ার ধামড়া গাইকে স্বচ্ছন্দে গোয়াল থেকে টেনে বের করে আনে রহিমা।
রহিমার শক্তি, চওড়া দেহ বাইরের খোলস মাত্র। আসলে সে ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ।
মজিদের কোরান তেলাওয়াতের চমৎকার সুরে সারা বাড়ি ভরে যায়- যেন হাস্নাহেনার মিষ্টি মধুর গন্ধ ছড়ায়।
গ্রামের লোকেরা যেন রহিমারই অন্য সংস্করণ। • কার্তিকে পানি সরে এলেও কচুরিপানা জড়িয়ে থাকে জমিতে।
কোচবিদ্ধ হয়ে নিহত ছমিরুদ্দিনের রক্তাপ্লুত দেহের পানে চেয়ে আবেদ জাবেদের মনে দানবীয় উল্লাস হয়।
শ্যেন দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে ধানকাটা দেখে মজিদ।
ঝালরওয়ালা সালুকাপড়ে আবৃত মাজারটিকে গাঁয়ের লোকেদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন। • মজিদ বলে- মাঠভরা ধান দেখে যাদের মনে মাটির প্রতি পূজার ভাব জাগে তারা বুত-পূজারী।
সাত ছেলের বাপ দুদু মিঞা কলমা না জানায় মজিদ তাকে খালেক ব্যাপারীর মক্তবে যাওয়ার আদেশ দেয়। • ছোটবেলায় নাকে নোলক পরে হলদে শাড়ি পেঁচিয়ে পরে ছুটোছুটি করত- রহিমা।
মজিদ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যোগসূত্র হচ্ছে রহিমা।
অতি সঙ্গোপনে মাজারের ধারে গিয়ে রহিমা সন্তানের জন্য আর্জি জানায়। চুন্নুর বাপ মরণরোগ যন্ত্রণা পাচ্ছে, খেতানির মা পক্ষাঘাতে কষ্ট পাচ্ছে, বড় নদীতে ঝড়ের মুখে ডুবে মারা গেছে ক-টি লোক।
চার গ্রাম পরে বড় নদী।
তাহের আর কাদেরের বোন হাসুনির মা আর তাদের কনিষ্ঠ ভাই রতন।
বতোর দিনে বাড়ি বাড়ি কাজ করে হাসুনির মায়ের ক্লান্তি নেই।
সারাজীবন দুষ্ট প্রকৃতির বৈমাত্রেয় এক ভাই এর সাথে জায়গাজমি সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করে সব দিক দিয়ে নিঃস্ব বুড়ো ঢেঙা লোকটি।
প্রাণের আশ মিটিয়ে বুড়ো তার মেয়েকে (হাসুনির মা) মারে। ক্রন্দনরত মেয়ে মজিদের ভালোই লাগে।
ঢেঙা বুড়ো লোকটা শয়তানের খাম্বা, অন্তরে তার কুটিলতা আর অবিশ্বাস।
পঞ্চম হিজরিতে প্রিয় পয়গম্বর বানি এল মুস্তালিখের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রত্যাবর্তন করবার সময় ছোট বিবি আয়েশা দলচ্যুত হয়ে পড়েন।
সর্বসমক্ষে ঢেপ্তা বদমেজাজি বৃদ্ধ লোকটি কাঁদতে শুরু করে।
মজিদ বৃদ্ধ লোকটিকে নির্দেশ দেয়-হাসুনির মার কাছে মাফ চাইতে এবং মাজারে ৫ পয়সার শিন্নি দিতে।
হাসুনির মা ছুটে গিয়ে চিড়াগুড় এনে দেয় নিজের বাপকে।
মজিদ হাসুনির মায়ের জন্য একটা শাড়ি আনিয়ে দেয়-বেগুনি রং, কালো পাড়।
বতোর দিনে মজিদ কিন্তু ভুলে যায় গ্রামের অভিনয়ে তার কোন পালা।
সকলকে মিঞা বলে সম্বোধন করার অভ্যাস মজিদের।
ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ পির সাহেবের পুরোনো মুরিদ। এক কালে আগুন ছিল তাঁর চোখে, আর কণ্ঠে বজ্রনিনাদ-পির সাহেবের।
ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক অঞ্চলে বংশানুক্রমে বসবাস করেছেন পির সাহেব। পির সাহেবের রুহানি তাকত ও কাশফ নিয়ে গল্পের শেষ নেই।
মজিদ যখন আওয়ালপুর গ্রামে পৌঁছালো তখন সূর্য হেলে পড়েছে। মতলুব মিয়া জানান, পির সাহেব সূর্যকে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখেন।
আওয়ালপুরের পির সাহেব একটা ফারসি বয়েত বলে ওয়াজ ক্ষান্ত করেন। ভাদ্র মাস থেকে ছায়া আছলি এক এক কদম করে বেড়ে যায়।
বড় সড়কটার দক্ষিণ দিকে করিমগঞ্জে একটি হাসপাতাল আছে।
কালু মিয়ার মাথায় মস্ত ব্যান্ডেজ।
খালেক ব্যাপারীর প্রথম পক্ষের বিবি আমেনার তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল।
খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তানু বিবির ভাই ধলা মিয়া বোকা কিছিমের মানুষ।
আওয়ালপুর ও মহব্বতনগরের মাঝপথে একটা মস্ত তেঁতুল গাছ পড়ে, সবাই জানে সেটা দস্তুরমত দেবংশি।
মোল্লা শেখের বাড়ির কাছে কাঁঠালগাছের তলে দাঁড়িয়ে ছিল হাসুনির মা।
তাহের-কাদেরের মায়ের জানাজা মোল্লা শেখ পড়েছিল।
তানু বিবি অবিশ্রান্ত পান বানায় আর মেহমানদের খাওয়ায়।
তানু বিবি একটু বোকা অথচ দেখাকি কিছিমের মানুষ। আমেনা বিবির গায়ে মাথায় হলুদ রঙের বুটিদার চাদর।
আমেনা বিবি পালকি চড়ে বাড়ি থেকে মাজারে যায়।
রহিমা মনে মনে স্থির করেছিল পাক দেয়া ঢুকে গেলে আমেনা বিবিকে ভেতরে নিয়ে যাবে, সখ করে যে ফিরনিটা করেছে তা খেতে দেবে।
মজিদ বলে যে পেটে বেড়ি পড়ে বলেই স্ত্রীলোকের সন্তানাদি হয় না। সাত প্যাঁচে বেশি হলে তা ছাড়ান যায় না।
মজিদের কথায় রহিমার চৌদ্দ প্যাঁচ।
রহিমা আর হাসুনির মা পাঁজাকোল করে মূর্ছা যাওয়া আমেনা বিবিকে ভেতরে গিয়ে যায়। মজিদ খালেক ব্যাপারীকে আমেনা বিবিকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দেয়।
আমেনা বিবির কোনোদিন রূপের ঠাঁট ছিল না, সৌন্দর্যের চেতনা ছিল না, চলনে-বলনে বেহায়াপনাও ছিল না। থোতামুখের তালগাছটা ছিল নিশানা, আনন্দের আর সুখের।
মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস গ্রামে ইস্কুল বসাতে চায়। আক্কাস করিমগঞ্জে ইস্কুলে পড়াশোনা করেছে কিছু।
বিদেশফেরত আক্কাস করিমগঞ্জে গিয়ে কাউকে দিয়ে জোরালো গোছের আবেদনপত্র লিখিয়ে এনে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিল। শহর থেকে মিস্ত্রি-কারিগর আনিয়ে তৈরি হয় একটা গম্বুজওয়ালা মসজিদ।
আওলাঘেরের নিচু চালের ওপর রহিমা কদুর বিচি শুকাবার জন্য বিছিয়ে দিচ্ছিল।
জ্যৈষ্ঠ মাসে মসজিদের কাজ শেষ হয়।
মজিদের দ্বিতীয় বউ হয়ে যে মেয়ে ঘরে আনে সে যেন ঠিক বেড়ালছানা।
জমিলাকে পেয়ে রহিমার মনে শাশুড়ির ভাব জাগে।
মজিদ বলে- মুসলমানের মাইয়ার হাসি কেউ কখনো হুনে না।
খোদেজা বুবু বেড়ার ফাঁক দিয়ে মজিদকে দেখিয়েছিল জমিলাকে।
জমিলা তার কান্নার যে মিথ্যে কারণ বলে- বাড়িতে ফেলে আসা নুলা ভাই এর জন্য মন খারাপ।
একদিন সকালে শনের মতো চুলওয়ালা খ্যাংটা বুড়ি মাজারে এসে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুরু করে।
বুড়ির সাতকুলে কেউ নেই, এখন তার চোখের মণি একমাত্র ছেলে জাদুও মরেছে। বুড়ি কোমরে গোঁজা আনা পাঁচেক পয়সা বের করে মজিদের দিকে ছুঁড়ে দেয়।
জমিলার চোখ যেন পৃথিবীর দুঃখ বেদনার অর্থহীনতায় হারিয়ে গেছে।
ডোমপাড়ায় অবিশ্রান্ত ঢোলক বেজে চলে।
ঘুম ভাঙলেই মজিদের একবার আল্লাহু আকবার বলার অভ্যাস।
জমিলার ঘুম কাঠের মতো।
• হঠাৎ এমন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর (জমিলা) সম্মুখীন হয় যে, মজিদ বুঝে উঠতে পারে না তাকে কীভাবে দমন করতে হবে।
মজিদ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেছোয়াক করে।
লোকেদের পাঠানো চাল-ডাল মজিদ ছুঁয়ে দিলে রহিমা তা দিয়ে কাটা চুলায় ব্যাপারীর বড় ডেকচিতে শিরনির খিচুড়ি রান্না করে।
রহিমার আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড়, তার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল।
রহিমা মজিদের ঘরের খুঁটি।
মজিদ জমিলাকে রাতে তারাবি নামাজ পড়ে মাজার-এ গিয়ে মাফ চাইতে আদেশ দেয়। সে রাতে দীর্ঘকাল সময় জমিলা জায়নামাজে ওঠাবসা করে।
জমিলাকে সোজা মাজার ঘরে নিয়ে ধপাস করে তার পদপ্রান্তে বসিয়ে দিল মজিদ।
মধ্যরাতের স্তব্ধতার মধ্যে মজিদ ভেতরের ঘরের দাওয়ার ওপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে জমিলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদের জন্য ।
মজিদের কণ্ঠে গানের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে পদের সূরা আল ফালাক। শিলাবৃষ্টি শুরু হলেও রহিমা চুপ মেরে বসে থাকে।
রহিমা বলে-“ধান দিয়া কী হইব মানুষের জান যদি না থাকে?””
একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্মবেদনার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা মজিদ অনুভব করে মনে মনে।
নলি হল জাহাজে চড়ার অনুমতিপত্র।
বাহে মুলুকে বলতে উত্তরবঙ্গ এলাকা বোঝানো হয়েছে।
কোঁচ-মাথায় তীক্ষ্ণ শলাকাগুচ্ছ যুক্ত বর্শা বিশেষ।
জাহেল অর্থ অজ্ঞ/মূর্খ/নির্বোধ।
আনপাড়হ্- যাদের পড়াশোনা জ্ঞান নেই এমন লোক।
বেওয়া অর্থ বিধবা।
শ্যেন দৃষ্টি হল বাজপাখি বা শিকারি পাখির মতো দৃষ্টি।
বুত পূজারী হল যারা মূর্তি পূজা করে।
ঋঝুভঙ্গিতে অর্থ সোজাসুজিভাবে।
রদ্দি অর্থ পচা/বাসি।
আমসিপানা মুখ – শুকিয়ে যাওয়া মুখ ।
তোয়াক্কল অর্থ ভরসা/নির্ভর/বিশ্বাস/ আস্থা।
রুহানি তাকত ও কাশফ হল আত্মিক শক্তি উন্মোচন করা।
তকলিফ অর্থ কষ্ট।
জইফ অর্থ অতি বৃদ্ধ।
কেরায়া নায়ের মাঝি অর্থ ভাড়াখাটা নৌকার মাঝি।
শিরালি- শিলাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যারা মন্ত্র বা দোয়া পড়ে।
বরগা- ছাদের ভর ধরে রাখার কাঠ বা লোহা।
হুড়কা-দরজার খিল ।
নফরমানি অর্থ অবাধ্য।